বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট : নতুন যুগে বাংলাদেশ

ভূমিকা : বাংলাদেশের মহাকাশ জয়ের গল্প রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হলো, যা ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকবে যুগযুগ ধরে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহকাশ অভিযানের সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বাংলাদেশের প্রথম ভূস্থির যোগাযোগ উপগ্রহ। এটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত হবে।

স্যাটেলাইট কী : স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ হলো মহাকাশে উৎক্ষেপিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত উপগ্রহ। এই মানবসৃষ্ট উপগ্রহকে বলা হয় কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে এমনভাবে পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে যাতে এর গতির বহির্মুখী শক্তি স্যাটেলাইটকে বাইরের দিকে গতি প্রদান করে কিন্তু পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পৃথিবীর আওতার বাইরে যেতে দেয় না। উভয় শক্তি স্যাটেলাইটে ভারসাম্য প্রদান করে এবং স্যাটেলাইট পৃথিবীর চুতর্দিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। যেহেতু মহাকাশে বায়ুর অস্তিত্ব নেই, তাই এটি বাধাহীন পরিভ্রমণ করে। স্যাটেলাইট বৃত্তাকার পরিভ্রমণ করে না, এর গতিপথ ডিম্বাকার কারণ পৃথিবীর আকৃতি ডিম্বাকার। পৃথিবী থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগন্যাল বা ডেটা পাঠানো হয়, স্যাটেলাইট সেগুলো গ্রহণ করে এবং এম্পলিফাই করে পৃথিবীতে প্রেরণ করে।

ইতিহাস : ২০০৮ সালে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর ২০০৯ সালে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিটের কাছে ইলেকট্রনিক আবেদন করে বাংলাদেশ। কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থার নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশীপ ইন্টারন্যাশনাল কে নিয়োগ দেওয়া হয়। স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের কোম্পানি থেলিস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে ১ হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি। ২০১৫ সালে বিটিআরসি রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনার আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। ২০১৭ সালে কৃত্রিম উপগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি নিমিটেড নামে একটি সংস্থা গ্রঠন করা হয়। এই সংস্থার প্রাথমিক মূলধন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় ৫০০০ কোটি টাকা।

বিবরণ : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস কর্তৃক নকশা ও তৈরি করা হয়েছে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি মালিকানাধীন মহাকাশযান সংস্থা স্পেস-এক্স থেকে উৎক্ষেপণ করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১৬০০ মেগা হার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০ টি কু এন্ড সি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করছে। স্যাটালাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকার রঙের নকশার উপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে।

নির্মাণ ব্যয় : কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একনেক সভায় ২৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৩১৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা যা মোট ব্যয়ের ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিডার্স ফাইন্যান্সিং এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য ১৬৫২ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হংকং ব্যাংকিং কর্পোরেশনের সাথে সরকারের প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়। ১.৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

নির্মাণ : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস। এটির নির্মাণ শেষ হয় ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ। নির্মাণ, পরীক্ষা, পর্যালোচনা ও হস্তান্তর শেষে বিশেষ কার্গো বিমানে করে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা কেইপ কেনাভেরালের লঞ্চ সাইটে পাঠায়। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ওজন তিন হাজার কেজি।

যা আছে : এই স্যাটেলাইটে ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার আছে। যার ২০ টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। আর বাকি ২০ টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।

কক্ষপথ কেনা : স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ কেনা হয়। মহাকাশে এই কক্ষপথের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এই কক্ষপথ কেনা হয়।

স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট : বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত। শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভূক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন : বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায়। এর মধ্যে গাজীপুরের তেলীপাড়ায় টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রাইমারি গ্রাউন্ড স্টেশনটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। এটিই মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের। আর রাঙ্গামাটি গ্রাউন্ড স্টেশনটি গাজীপুরে স্থাপন করা গ্রাউন্ড স্টেশনের বিকল্প।

উৎক্ষেপণ : স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ উৎক্ষেপণ যানে করে ১২ মে বাংলাদেশ সময় রাত ২ টা ১৪ মিনিটে (২০:১৪ ইউটিসি ১১ মে ২০১৮) সফলভাবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ফ্যালকন ৯ রকেটের নতুন ব্লক ৫ মডেল ব্যবহার করে প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সুবিধাসমূহ : বর্তমানে দেশের টেলিভিশন চ্যালেনগুলো সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এজন্য বছরে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট চালুর ফলে অনেকাংশেই কমে আসবে এ ব্যয়। টেলিভিশন চ্যালেন ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরণের সেবা পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেকোন ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগ, টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবেশ যোগাযোগ মাধ্যম ই-সেবা নিশ্চিত করবে। এছাড়া আবহাওয়ার পূর্বভাস, টেলিমেডিসিন, ই-লানিং, ই-রিসার্চ, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালো তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে নেপাল মিয়ানমার, ভূটান ও অন্যান্য দেশের কাছে সেবা ভাড়া দিতে পারবে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা যাবে। স্যাটেলাইট ভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটটি কাজে লাগবে। এটি আমাদের দেশে সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করবে, আবহাওয়ার গতি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে, ঝড়ের গতিবেগ ও পথ নির্ণয় করে ক্ষয় ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে। টিভি এবং রেডিও ব্রডকাস্ট আরও দ্রুত এবং মসৃণ হবে। এইচডি কোয়ালিটি বাড়ানো যাবে। নিজস্ব স্যাটেলাইটের জন্য ইন্টারনেটের গতি বাড়বে। ভূমি ও সমুদ্রে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানে সহয়তা করবে এবং ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি ইত্যাদি কাজে এটি ব্যবহৃত হবে।